আমাদের নবম দশম শ্রেণীতে একটা কবিতা ছিলো। শাহ মোহাম্মদ সগীরের ‘বন্দনা’ কবিতা। এখন এই কবিতাটা সিলেবাসে আছে কিনা জানি না। কবিতাটার চার লাইন এখানে দিলাম-
“দ্বিতীয়ে প্রণাম কঁরো মাও বাপ পায়
যান দয়া হন্তে জন্ম হৈল বসুধায়।
ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হন্তে বাড়
দোসর জনম দিলা তিঁহ সে আন্ধার।”
অর্থাৎ এখানে ‘ওস্তাদ’ বলতে শিক্ষককে প্রথমে প্রণাম করতে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় প্রণাম মা -বাবার জন্য। সেই সময় শিক্ষকদের সম্মান -শ্রদ্ধা এমনই ছিলো। সারা মহল্লা জুড়ে শিক্ষকদের মর্যাদা ছিলো অন্যরকমের। সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন তারা। আমরা ছোটবেলায় এভাবেই শিক্ষকদের দেখতাম। কিন্তু এখন অবস্থা ভিন্ন। এতটাই ভিন্ন যে, শিক্ষকদের সম্মান বিষয়টা আর নজরেই পড়ে না। কিন্তু কেন এমন হলো? বর্তমানে কিছুদিন পরপর শিক্ষকরা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন। তাদের বিভিন্ন রকমের ভাতা যেমন: বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা ইত্যাদি বহুবছর থেকে একই মাত্রায় আছে। কিন্তু প্রতিটা জিনিসের দাম বহুগুন বেড়ে গিয়েছে। তারা এগুলোর জন্য বাড়তি অর্থ দাবি করেন। খুবই যৌক্তিক দাবি। যেখানে সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানে তাদের বিভিন্ন ভাতা কেন বাড়ানো হবে না? কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, শিক্ষক হিসেবে আপনাদের জ্ঞান কি বাড়িয়েছেন?নিজেদের কতখানি আপডেট নিয়েছেন আপনারা? আপনাদের শিক্ষকদের কথা চিন্তা করেন তো, তারা যা জানতেন তার চেয়ে বেশি জ্ঞানার্জন করতে পেরেছেন কি? তাদের চেয়ে বেশি সম্মান পাচ্ছেন কি? সম্মান না পাওয়ার জন্য আপনারা ছাত্রছাত্রীদের এমনকি অন্যান্য সেক্টরের কর্মকর্তাদেরও দায়ী করেন। আমি আমার অনেক লেখায় এই কথাটা বলেছি যে, সম্মান-শ্রদ্ধা জিনিসগুলো নিজেকে অর্জন করতে হয়। আপনি যদি সম্মানের যোগ্য না হন, তাহলে কেউ এমনি এমনি এগুলো আপনাকে দিতে আসবে না। কিছু কিছু চাকরিজীবীর সবসময় পড়াশোনার মধ্যেই থাকা উচিত। অথচ দুঃখের বিষয়, আপনারা কোন কিছু পড়েন না। যে বিষয়ে আপনি পড়াবেন তা সম্পর্কেও সঠিক এবং বিস্তারিত জানা থাকে না আপনাদের। অথচ, পাঠদান প্রক্রিয়া এমন হওয়া উচিত যেন আপনার কথা শোনার জন্য বা আপনার ক্লাসের জন্য ছাত্রছাত্রীরা উন্মুখ হয়ে থাকবে। অথচ চিত্র যে কতটা ভয়াবহ তা আমরা অনেকেই জানি। ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যেতে চায় না, শিক্ষকদের পছন্দ করে না, শিক্ষকদের সামনেই ধূমপান করে, সামনে দিয়ে চলে গেলেও শিক্ষককে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেওয়ার প্রচলন ও উঠে গিয়েছে। এজন্য ছাত্রছাত্রীদের দোষ দেন, অভিভাবকদের দোষ দেন। দোষ অবশ্যই উভয়দিকেই আছে। তবে আগে শিক্ষককে সম্মান অর্জন করার জন্য জ্ঞানার্জন করতে হবে, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হতে হবে, অযৌক্তিক দুর্ব্যবহার করা যাবে না, আপনার পেশাকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যাবে না, ব্যক্তিগত আক্রমণ করা যাবে না– এমনি আরও অনেক গুণাবলি আপনাদের মাঝে থাকতে হবে। তবেই আপনারা যথাযথ সম্মান পাওয়ার আশা করতে পারেন।
পৃথিবীর বেশকিছু দেশে শিক্ষকতা সত্যিকার অর্থেই প্রথম শ্রেণীর পেশা। যেমন ভুটান, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি। এই দেশগুলোর শিক্ষকদের বেতন সব পেশার মানুষের চেয়ে বেশি। সম্মানও বেশি। কিন্তু শুধু তাদের বেতন এবং সম্মানের দিকে তাকালে হবে না, তাদের এই পেশায় ঢোকার প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত কঠিন। শিক্ষাগত যোগ্যতায় প্রথমদিকে থাকতে হয়, মানবিক আচরণ, পড়ানোর কৌশল, বিভিন্ন শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা বুঝে তার সাথে বিশেষ আচরন এমনই আরও অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে যে তারা আসলেই শিক্ষক হওয়ার যোগ্য কি না। তারপরও তাদের ক্লাসে সিনিয়র শিক্ষকরা প্রায়ই বসে থাকেন, যে তারা ঠিকমতো ক্লাসে পড়াতে পারছেন কিনা তা দেখার জন্য। এখন আপনারা, অর্থাৎ আমাদের দেশের শিক্ষকরা ভেবে দেখেন, এতোগুলো কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আপনারা যেতে পারবেন কিনা, বা এই ধরনের স্বদিচ্ছা আপনাদের আছে কিনা।
আবার কিছুদিন পরপর শিক্ষকদের রব ওঠে, ” সব পেশার মানুষেরা আমাদের স্যার-ম্যাডাম ডাকবে।”এর উত্তরে আমি বলবো ব্যক্তিগতভাবে কোন শিক্ষককে ‘স্যার’ ডাকতে আমার পরিবারের সদস্যদের অন্তত কোনো সমস্যা নেই। এখানে উল্লেখ করি, আমি আমাদের পেশার সিনিয়রদের স্যার ডাকি, কোন ডাক্তার যদি মেডিকাল কলেজের শিক্ষক হন তাহলেও আমি তাদের স্যার ডাকি। এমনকি প্রাইমারি স্কুলের বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষদেরও স্যার ডাকি। স্যার-ম্যাডাম ডাকটা শুনতে চান অথচ নিজেকে এই ডাকের উপযুক্ত করে তুলতে চান না! এখন বলুন, আপনাদের চাওয়াটা যৌক্তিক হলো কি?
আপনি যে বিষয়ের শিক্ষকই হন না কেন, কিছু সাধারণ বিষয় আপনাকে জানতেই হবে। যেমন ইতিহাস, দর্শন, মনোবিজ্ঞান এবং সর্বোপরি সারা বিশ্বে কি ঘটছে তা খেয়াল করতে হবে প্রতিদিন।
আমাদের ভাষা যেহেতু বাংলা তাই এই ভাষায় যারা অতি পরিচিত লেখক তাদের বই আপনাদের আগে পড়তে হবে। যেমনঃ আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, আহমদ ছফা, গোলাম মোস্তফা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ — এমনি আরও নাম যা বলে শেষ করা যাবে না! কবিদের তালিকাও দীর্ঘ! জীবনানন্দ দাস, হেলাল হাফিজ, শামসুর রহমান, রফিক আজাদ, তসলিমা নাসরিন, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ — এমন কত শত প্রতিভাবান কবির কবিতা আছে! অথচ আপনাদের সেগুলো পড়তে ইচ্ছাই করে না! কী আশ্চর্য! আপনাদের পেশাকে মহৎ পেশা বলে দাবি করেন। কিন্তু কোনো পেশার মহৎ হওয়ার ক্ষমতা নেই। মানুষই পেশাকে মহৎ করে তোলে।
(আগামী পর্বে শেষ হবে)