ইংরেজি ভাষায় দুটো শব্দ আছে। একটা হচ্ছে ‘থ্রোন’ যার অর্থ সিংহাসন এবং আরেকটা হচ্ছে ‘থর্ণ’ অর্থাৎ কাঁটা। দুটো শব্দের অর্থ ভিন্ন হলেও একটা বর্ণের এপাশ -ওপাশ মাত্র৷ আর শব্দ দুটোর অর্থ একটার সাথে অন্যটা পাশাপাশি জড়িত। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি যে, সিংহাসন আর কাঁটার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সিংহাসনে বসে থাকা মানে কাঁটার ওপর বসে থাকা। না পারা যায় এটার ওপর স্বস্তিমতো বসে থাকতে, না পারা যায় উঠে পড়তে। এটার এমনই সম্মোহনী ক্ষমতা! অথচ পৃথিবীর অল্পকিছু মানুষ বাদ দিলে প্রায় সবাই এই আসনটাতে বসতে চায়। অর্থাৎ ক্ষমতা এমন এক জিনিস যা থেকে মানুষ নিজেকে সংযত করতে পারে না। প্রায় প্রতিটা মানুষ তার আশেপাশে সবসময় কিছু মুগ্ধ মানুষ দেখতে চান, যারা তার সব কাজের প্রশংসা করবে, তিনি যা বলবেন তাই হবে, টেবিল ভর্তি ভালো ভালো খাবার, লোকলষ্কর, জৌলুষ ইত্যাদি থাকবে। এগুলোর আড়ালে পড়ে যায় ক্ষমতার আসল উদ্দেশ্য। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ এর ব্যবহার জানে না। তাই বিশ্বজুড়ে এই ক্ষমতাকে এককেন্দ্রিক করে রাখা হয়েছে। সৃষ্টির শুরু থেকেই এই ক্ষমতাকে নিয়েই লড়াই চলেছে মানুষে মানুষে। আর এই লড়াইয়ে প্রাণ গিয়েছে কোটি কোটি সাধারণ মানুষের। রক্তপাত ছাড়া কোনো ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
১৮৮৯ সালের দিকে রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় নিকোলাসের দরবারে একজন আধ্যাত্মিক গুরুর আবির্ভাব ঘটে, নাম তার গ্রেগরি রাসপুতিন। তিনি নিজেকে একজন জ্যোতিষী বলে পরিচয় দেন। আগে রাজদরবারে একজন রাজকীয় জ্যোতিষী থাকতো, যার কাজ হতো বিভিন্ন গ্রহ -নক্ষত্র বিচার করে রাজাকে তার আগাম বার্তা দিয়ে সহায়তা করা। রাসপুতিন যে ভবিষ্যতবাণী করতেন তাই ঠিক হতো। এভাবে কিছুদিনের মধ্যেই তার ক্ষমতার কথা সাধারণের মধ্যে প্রচারিত হয়ে গেলে তিনি আস্তে আস্তে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। এমনকি রাজা নিকোলাসকেও জনগণ তখন তেমন পাত্তা দিতো না। রাশিয়াতে রাসপুতিনের প্রভাব বেড়ে গেলে রাজা নিজেকে খুব দুর্বল ভাবতে শুরু করেন এবং একসময় তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। এর কার্যক্রম হিসেবে রাসপুতিনকে প্রথমে কেক এবং মদের সাথে বিষ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। কিন্তু বিধি বাম! সেই মারাত্মক বিষের প্রভাবেও তার কিছু হয়নি। তারপর তাকে সুযোগ বুঝে তিনবার গুলি করা হয়, তাতেও তিনি মারা যাননি। অবশেষে তাকে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। রাসপুতিন মারা যান পানিতে ডুবে! এতগুলো মৃত্যুফাঁদ তাকে অলৌকিকভাবে বাঁচালেও পানিতে পড়ে মৃত্যুটা কেমন যেন অস্বাভাবিক ঠেকে আমার কাছে। অবশ্য রাশিয়ার তাপমাত্রা গড়ে -৫০° থাকে সারা বছর। রাসপুতিন একটি ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে, তার মৃত্যুর পরপরই রাশিয়ার সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। এবং সত্যিই তাই হয়েছিলো। এখানে লক্ষ্য করুন, রাসপুতিনের ক্ষমতা কিছুটা হলেও ছিলো বলেই ইতিহাস দাবি করে। কিন্তু তারপরেও তার মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ অনন্তকাল কেউ ক্ষমতার অধিকারী থাকতে পারে না। তারা সম্ভবত মৃত্যু নামক জিনিসটা ভুলেই যান! যেটা তাকে একদিন নিয়ে যাবে অন্য কোন ভুবনে, যেখানে কোন ক্ষমতাই আর কাজে দিবে না। সেখানে বরং পৃথিবীতে ক্ষমতায় থেকে কি কি অপকর্ম করেছেন তার সূক্ষ্ম হিসাব নেওয়া হবে। অনেকসময় এ বিচার পৃথিবীতেই দিতে হয়। ইতিহাস মানুষ পড়লেও এখান থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।
পৃথিবীতে অনেক ক্ষমতাবান, পরাক্রমশালী মানুষ ছিল। মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবরের শরীরে তৈমুর লং এবং চেঙ্গিস খান এই দুই বর্বর, দুর্ধর্ষ ব্যক্তির রক্ত ছিলো। তৈমুর লং* এবং চেঙ্গিস খান* দুইজনেই বর্বরতার সীমা লঙ্ঘন করেছিলো। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ তাদের অধীনে ছিলো। বলা হয়ে থাকে যে, তারা যেদিক দিয়ে যেতো, সেদিকের পুরো অংশ হত্যা, লুট, ধর্ষণ এবং সবশেষে আগুনে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে যেতো। তাই বলে তারা কিন্তু একসাথে কাজ করতো না। তাদের কাজের ধরণ একই হলেও দুইজনের জন্মের সময়ের পার্থক্য প্রায় দুইশো বছর। চেঙ্গিস খান একাই পঁচিশ-তিরিশ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছিলো। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তখন কি তারা তাদের ক্ষমতা হারানোর কথা কখনো ভাবতো? মৃত্যুকে কখনো উপলব্ধি করতো? পৃথিবী কাঁপানো নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট, মোঘল অধিপতিরা সবাই চলে গিয়েছেন। রেখে গেছেন অসংখ্য মানুষ হত্যার অপরাধ, অনেক মানুষের গভীর দীর্ঘশ্বাস! এখনো পৃথিবীর অসংখ্য ক্ষমতাবান মানুষেরা নিজেদের অপকর্মকে স্বীকার করে না। রাজনীতি মানেই হচ্ছে ভয়ংকর মিথ্যাচার, নির্মম হত্যাকান্ড, চুরি ইত্যাদি। সুস্থ রাজনীতি খুব কম জায়গায় দেখা যায়। দেশের সাথে বেঈমানী করেও নিজেকে নিরাপরাধ দাবি করে! এর চেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে? অথচ ক্ষমতা দিয়ে কত-শত ভালো কর্ম করা যায়!
এইসব ক্ষমতাবান মানুষদের বাইরেও পৃথিবী জুড়ে অল্প কিছু মানুষ আছে যারা’ মিনিমালিজমে’ (স্বল্পবাদ) বিশ্বাস করে এবং সেইভাবে জীবন যাপন করে। আমিও এই জীবনকে পছন্দ করি। আমি যখন অনার্সে পড়ি তখন একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি পড়াশোনা শেষ করে কি হতে চাও?” আমি বলেছিলাম, “আমি উল্লেখ করার মতো কিছুই হতে চাই না। সুন্দর এবং পরিপাটি করে সংসার করতে চাই, যেখানে খুব প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোই শুধু থাকবে। কোনো বাহুল্যতা থাকবে না। তারপর একদিন খুব গোপনে নিঃশব্দে টুপ করে মারা যাবো।” কেউ জানবে না ‘আমি’ বলে কেউ ছিল কখনো।
(তথ্যসূত্রঃ দ্য আর্থ শেকার — হ্যারল্ড ল্যাম্ব,
চেঙ্গিস খান — ভাসিলি ইয়ান, অনুবাদ — অরুণ ঘোষ এবং উইকিপিডিয়া)